বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন-
“খুব সম্ভব উনিশশো আটষট্টি সাল সেটা। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার বছর-দেড়েক পার হয়েছে আমার। আমার অনুষ্ঠান ততদিনে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। একদিন স্কুটার চালিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা ভোক্স-ওয়াগন গাড়ি আমাকে পার হয়ে রাস্তার বাঁ দিক চেপে আমার পথ আটকে দাঁড়াল।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে গাড়ির ভেতরে তাকালাম; দেখলাম, স্টিয়ারিং-এ বসে আছেন আমাদের সুচিত্রা সেন- সেই আগের মতোই রমণীয় আর অনিন্দ্য। সঙ্গে তার দুই স্কুল-পড়া ছেলে- রুমী আর জামী। সে-সময়কার ছোট্ট জনবিরল ঢাকা শহরে যে হাতে-গোনা দু’একজন মহিলা গাড়ি চালাতেন, তিনি তাদের একজন।
আমি থামতেই তিনি হাসিমুখে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। সহজ স্বরে বললেন: ‘একটু অভদ্রতা করলাম। আমার দুই ছেলে আপনার দারুণ ফ্যান, আপনাকে দেখে গাড়ির ভেতরেই হৈচৈ লাগিয়ে দিলো’ বলে দুই ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।”
দীর্ঘ একটা লেখা থেকে অল্প কিছু লাইন কোট করলাম। কোট করার একটা উদ্দেশ্য আছে।
আজকের একজন আমি কিংবা আমরা জাহানারা ইমামকে যেভাবে দেখি, ৯০ দশকের পরের প্রজন্ম আম্মাকে যেভাবে দেখে অভ্যস্ত সেটাই আম্মার পুরোটা না এবং আমার মনে হয় আম্মাকে পুরো বোঝাটা দরকার। নিঃসন্দেহে আম্মা ছিলেন গণ-আদালতের, নির্মূল কমিটির, শাহাবাগের সর্বপোরি এই একুশ বছরের একটানা আন্দোলনের সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি। অর্থাৎ জাহানারা ইমাম নামক এই মানুষটার জন্ম না হলে হয়তো মুজাহিদ আর সাকাকে কাঁপতে কাঁপতে বাথরুমে যেতে হতো না কখনো।
জাহানারা ইমামকে আমরা সবাই চিনি। তার লেখা বই “একাত্তরের দিনগুলি” নাকি বাংলার মাটিতে আট লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। এখনো যে কোন মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের তালিকা করলে প্রথমে এই বইটার নাম এসে যায়। কিন্তু ‘একাত্তরের দিনগুলো’ দিয়ে আম্মাকে চেনা যাবে না; চেনা যাবে রুমিকে, চেনা যাবে মুক্তিযুদ্ধকে, চেনা যাবে একাত্তরের সরাসরি উত্তাপকে। তিনি সজতনে নিজেকে সরিয়ে রেখে বারবার নিজের সন্তানের কথা, স্বামীর কথা, পরিবারের কথা বলেছেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রভাস আমিন তার এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নিয়ে আম্মার সাথে তার স্মৃতিচারণের কথা।
“…আম্মা আমাকে বললেন, আচ্ছা বলতো এত বই থাকতে, ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এত জনপ্রিয় হলো কেন? একটু ভেবে আমি বললাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বই পড়েছি, সবগুলোতেই লেখক নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। পড়লে মনে হয়, লেখক না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম একাত্তরের দিনগুলি।
এখানে লেখক খুব নির্মোহ, নিস্পৃহ। লেখক শুধু ঘটনার বর্ননা দিয়ে গেছেন, নিজেকে মহান করতে চাননি। তাই এই বইটি হয়ে উঠেছে একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকার দিনপঞ্জি। তিনি হাসলেন, প্রশ্রয়ের হাসি। বললেন, ভালো বলেছিস। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠলো।”
৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর, বিজয়ের মাত্র একদিন আগে মারা যান জাহানারা ইমামের স্বামী, রুমি ত হারিয়ে যায় আরও আগে। একটা মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের সবকিছু কেড়ে নেয় কিন্তু তবু এই দৃঢ়চেতা নারী বিজয় দিবসে পতাকা ওড়ান বাসার ছাদে। যেই স্বাধীনতার জন্য হারালেন স্বামী-সন্তান সেই স্বাধীনতাকে-সেই জন্মভূমিকে আঁকড়ে ধরেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কি দুর্ভাগ্য, তাঁর যুদ্ধ তখনো শেষ হয় নি। যুদ্ধের তো কেবল মাত্র শুরু।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের পতন ঘটে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে ভেতরের যে পাকিস্তান সেই পাকিস্তানের পতন তো তখনো ঘটে নি। যেই আদর্শকে বুকে নিয়ে রুমিরা অকাতরে জীবন দিয়েছিলো সেই আদর্শের বিরোধিতাই হল আরেক পাকিস্তান, এই পাকিস্তানই তো আসল পাকিস্তান।
শোষিত নিপীড়িত মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লক্ষ মানুষের রক্তের ওপর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাকে কেন্দ্রে রেখে যেই সমাজ গঠনের কথা ছিলো- অচিরেই সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলো। তৎকালীন শাসকেরা একাত্তরের খুনি রাজাকার আলবদরদের একে একে দেশে ফিরিয়ে আনা শুরু করলো; বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার প্রয়াসে। দেশবিরোধী আর স্বাধীনতাবিরোধী গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পেলো।
বাংলার মাটিতে জামায়াত একাত্তরের গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমকে তাদের আমীর বানালো। এই দৃশ্য জাহানারা ইমামের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ছিলো। তিনি শুরু করলেন তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধটি।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে শহীদ জননীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে এক সুবিশাল জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের পক্ষ থেকে জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।সারা পৃথিবীময় জাহানারা ইমাম পরিচিতি পান বিশ্বের এক অন্যতম বৃহৎ গণ-আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন বিএনপি সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১২ এপ্রিল ১৯৯২ সালে গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে পেশ করেন।
১০০-জন সাংসদ গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপি গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। সরকার ৩০ জুন ১৯৯২ সালে সংসদে ৪ দফা চুক্তি করে। ২৮ মার্চ ১৯৯৩ সালে নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়।
পুলিশ জাহানারা ইমামকে এমনভাবে মারে যে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর খুব দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে জাহানারা ইমামের।
২ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়েট হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। ২২ এপ্রিল চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসার আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছেন তিনি। তাঁর মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারের বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা আর সম্ভব নয়। বাকশক্তি হারিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। এ সময় ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন। ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালের বেডে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
একঝলকে জাহানারা ইমামকে দেখলে চোখে পড়ে কৈশোরের সাইকেল চালানো, যৌবনের নাটকে অভিনয়, পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা ঘরদোর, গান শোনা, গাড়ি চালানো, অসাধারণ স্ত্রী, মমতাময়ী মা সব মিলিয়ে উন্নত রুচিশীল উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন মানুষ। কিন্ত সময়ের প্রয়োজনে নিজের আদর্শের টানে ঘর ছেড়ে এলেন রাজপথে। গড়ে তুললেন এই বৃহৎ আন্দোলন। তাঁর গোটা জীবনটাই তো একটা আদর্শ।
জাহানারা ইমাম চলে গেছেন, কিন্তু রয়েছে তাঁর আদর্শ। এই ভূখণ্ডে নারীমুক্তির আন্দোলনকে, ধর্মান্ধতা-বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে আমাদের সবারই জানতে হবে এই মানুষটি সম্পর্কে। জাহানারা ইমাম তাঁর লেখা শেষ চিঠিতে তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায় দিয়ে গেছেন আমাদের হাতে। লিখেছেন-
“তবু আমি জানি; জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়…”
1971: genocide-torture archive & museum