ভার্নিশবিহীন অমসৃণ কাঠের কফিনে প্রবাসীর লাশটা বিমানবন্দরে পড়ে থাকে!

আজকে একজন প্রবাসী শ্রমিক মারা গেল। কিছু দিনের মধ্য ভার্নিশবিহীন অমসৃণ কাঠের কফিনে লাশটা বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছবে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। শুধু মালয়েশিয়া থেকেই প্রতিদিন বলতে গেলে দুজনের লাশের বাক্সো গিয়ে বিমানবন্দরে পড়ে থাকে। পড়ে থাকে যেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির নিথর দেহ স্বজনেরা নিয়ে যেতে পারে।
যার লাশ তার সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। সবজিতে দেশীয় গন্ধ পাবার আশায় আমি যে বাংলাদেশি দোকানে মাঝেমধ্যে যাই সেখানে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কারো পরিচয়ের সূত্র ধরে এসেছিল একটা কাজের আশায়। দোকানে কেউ ঢুকলে তার চোখেমুখে এমন আতঙ্ক খেলে যাচ্ছিল যেন তাকেই ধরতে এসেছে। দোকানে আমাকে বাংলায় কথা বলতে দেখে আস্বস্ত হয়েছিল, হাতের পত্রিকার দিকে ইশারা করে জানতে চেয়েছিল, বাংলা না ইংরেজি নাকি বাহাসা? আমি হেসে বলেছিলাম, বাহাসা তো জানি না আর বাংলা এখানে কোথায় পাব, ভাই? হঠাৎ কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠেছিল, পড়ালেখা জানি না, এইখানে আসার সময়ে সেইটা লাগে নাই। কিন্তু এক কাজের জন্য ছয় জন লোক আনছে। এইটা কি উচিত হইছে, আপা? একজন কাজ পাইল আর আমি এইখানে ওইখানে ঘুরতেছি। কাজ নাই, কাগজ কইরা দিব বইলা পাসপোর্টও নিয়া রাখছে এজেন্ট। কিন্তু আমি এইরাম কইরা কদ্দিন ঘুরব?
কেউ কাজ দেয় না। পাসপোর্ট ছাড়া দেশে যাব কেমনে আর কোন মুখে যাব? আসার সময়ে জমি বন্ধক রাখছি, গরু বিক্রি করছি, চাইর লাখ টাকা লাগছে। পাঁচ মাস এইখানে একদিন ওইখানে আরেকদিন লুকায়ে কাজ করতেছি। বাড়িতে কইতেও পারতেছি না, ওরা যেন চিন্তা না করে তাই না-খাইয়া সামান্য টাকাও পাঠাইছি, খুবই সামান্য…
বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলেছিল যেন দোকানে উপস্থিত সবার কাছে বিচার দেয়া।বলাবাহুল্য, দোকানটায় তার কাজ হয়নি। অবৈধ কাউকে কাজে রেখে সহজে কেউ বিপদ ডেকে আনতে চায় না। পরে শুনেছিলাম ছেলেটাকে চলে যেতে হয়েছিল শহর থেকে দূরের কোনো ফ্যাক্টরিতে যেখানে কেউ সচরাচর তাকে খুঁজে পাবে না।
আজ যখন সেই দোকানে দেশি ধনিয়া পাতা কিনতে গেছি, কে যেন বলল, রাব্বি মারা গেছে।
কে রাব্বি?
ওই যে, আপা, একদিন আপনের সামনে খুব কান্না করলো।
আহা, এত অল্প বয়সে, কী করে?
হার্ট অ্যাটাক। কোন এক ফ্যাক্টরিতে ছিল, কাজের সময়ে ভিতরে গরমে নাকি টিকতে পারত না। আর রাইতে ফ্যাক্টরির পিছনে মাঝারি একটা ঘরে গাদাগাদি কইরা বিশ-বাইশজন মানুষ ঘুমাইত । মালিক বলছিল পুলিশ এইখানে আসবে না। কিন্তু ছয়মাসের বেতন আটকায়ে রাখছে। ওইদিকে এজেন্ট বলছে তিন হাজার রিঙ্গিত দিলে কাগজ কইরা দিবে। সে বেতনের টাকা পাবে মনে কইরা চাকরি ছাইড়া নড়তে পারে নাই। তবু ভালো, মালিক হার্ট অ্যাটাকের কথা স্বীকার করছে। মানে, কিছু টাকা দিয়া দিবে। আত্মহত্যা কইয়া দিলে তো সেইটাও দেওন লাগত না।
এটা কল্পকাহিনী নয়। আধুনিক দাসত্বের শিকলে আটকে পড়া এই মানুষগুলো বিন্দু বিন্দু করে টাকা পাঠিয়ে আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সিন্ধু গড়বে, এটাই তো আমরা নিশ্চিত করতে চাই! কিন্তু শুধু এখানেই বাইশ-তেইশ বছর বয়সে প্রতিদিন তাদের দুজনকে কেন হার্ট অ্যাটাকে মরতে হয় তা নিয়ে আমাদের কোনো কৌতূহল নেই। রাব্বিও হয়ত সিকি কি আধা বিন্দু টাকা পাঠিয়েছিল, অনেকেই পাঠায় যারা নির্মাণাধীন উঁচু ভবন থেকে পড়ে গিয়ে মরে, স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মরে, এভাবে মরে, সেভাবে মরে… যত্রতত্র এসব মৃত্যু অতি গুরুত্বহীন, অত্যন্ত তুচ্ছ।
কখনো তাদের জন্য আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু হা-হুতাশ করে। অবশ্য আমার মতো কেউ এরকম একজন রাব্বির পরিণতির কথা শুনলে দেশি ধনিয়া পাতার সুগন্ধের পরিবর্তে মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ফিরে আয়েশ করে বসে রাব্বিকে বাড়িয়ে চড়িয়ে একটা গল্প লেখে। তারপর তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যায়। কোনোদিন কোনো পাঠক তা পড়ে বলে, বাহ্, অদেখা একটা জীবন অদ্ভুতভাবে তুলে এনেছেন তো!
এসব কল্পকাহিনী হলে ভালো হতো। জীবন কল্পকাহিনীর চেয়ে নিষ্ঠুর।
মালইয়েশিয়া থেকে লিখেছেনঃ আফসানা বেগম