রক্ষাকবচ- মাষ্ক আর ব্যক্তিদুরত্ব – সাঈদ তারেক , লেখক নির্দেশক

পরশু রাতে টিভি টক শো’য় এক বিশেষজ্ঞকে বলতে শুনলাম, করোনার ফাইনাল হিট নাকি শুরু হবে পনেরোই জুলাই থেকে! পিকে উঠবে পঁচিশে। মৃত্যুর সংখ্যা কততে দাঁড়াতে পারে সে সম্পর্কে নির্দিস্ট করে কিছু বললেন না তবে এটা জানালেন পনেরো তারিখ থেকে র‌্যাপিড বাড়তে বাড়তে দৈনিক পাঁচ শ’তেও ঠেকতে পারে। এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত নয় করোনা নিয়ে বৈশ্বিক গবেষনায় রত একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ সম্পর্কিত পুর্বাভাস।
এসব গবেষণা পুর্বাভাষের ওপর আমার আস্থা খুবই কম। গত বছরও কোন কোন সংস্থা জানিয়েছিল বাংলাদেশে করোনায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। আমি তখনই ফালতু বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় লেজেগোবরে অবস্থা- সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে, আসলেই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তথ্যাভিজ্ঞরা বলছেন প্রতিদিন সরকারের পক্ষ থেকে সনাক্ত এবং মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে তা এক ধরনের স্ন্যাপশট। পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ধারনা। অনেক তথ্যই এখানে সংযুক্ত হয় না। প্রদর্শিত চিত্রের চাইতে বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। জেলা উপজেলা ছাড়িয়ে সংক্রমন এখন গ্রাম এলাকায়। গ্রাম ইউনিয়ন উপজেলা তো বটেই অনেক জেলায়ও করোনা টেস্ট বা পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ নাই। অথচ ঘরে ঘরে আক্রান্ত। একজন থেকে দ্রুত তা পরিবারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এরা টেস্টের আওতা বহির্ভূত। টেস্ট করাতে জেলা শহরে যাবে তারও উপায় নাই, লকডাউন দিয়ে সরকার সব যানবাহন বন্ধ করে রেখেছে। যারা ঘরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের কোন তথ্য সরকারের কাছে নাই। মৃত্যুর সংখ্যা শুধু রেকর্ড করা হয় যারা হাসপাতালে এসে মারা যান বা সরকারি নথিতে ইতিপুর্বে করোনা পজিটিভ বলে তালিকাভুক্ত। তালিকার বাইরে মারা গেলে তারা হন ‘উপসর্গ নিয়ে’ মৃত।
এর ওপর রয়েছে চিকিৎসা সংকট। নানা এন্টিবায়োটিক অষুধ পথ্যে হয়তো এই রোগ সেড়ে যায় কিন্তু সবচেয়ে বড় যা প্রয়োজন তা হচ্ছে অক্সিজেন। রাজধানী শহর এবং বড় বড় কয়েকটি জেলা শহর ছাড়া গ্রাম ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সুবিধার কোন বালাই নাই। এসব জায়গায় কার্যত: কোন হাসপাতালই নাই। ফলে বিস্তির্ণ গ্রামাঞ্চলের আক্রান্তদের আল্লাহর ওপর ভরষা করে থাকা ছাড়া কোন গত্যন্তর নাই। অবস্থাপন্নরা ভ্যানে বাইকে চাপিয়ে রাস্তায় নানা বালা মুসিবত ম্যানেজ করে কোনমতে রোগীকে জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত আনতে পারছেন, যারা আরও টাকা খরচ করার সঙ্গতি রাখেন এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় নিয়ে আসছেন, এর বাইরে গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার ক্রিটিক্যাল রোগীর দাপাতে দাপাতে মারা যাওয়াই একমাত্র কপালের লিখন।
এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেয়া দুরূহ ব্যপার। সরকারের সে সক্ষমতা নাই তার প্রমান তারা বহুবার দিয়েছে। দেড় বছর সময় পেয়েছে, এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব যে হতে পারে মনেই করে নাই। ডেল্টা যখন ভারতকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে তখনও কোন প্রস্ততি গ্রহন করে নাই। অথচ সবারই জানা ছিল এই ঢেউ আমাদের এখানেও আছড়ে পড়বে। গত বছর করোনা এলো আকাশ পথে বিমানবন্দর দিয়ে এবার এলো হাঁটাপথে সীমান্ত দিয়ে। নাম কা ওয়াস্তে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট বন্ধ করা হলো কিন্তু হিসাবেই ছিল না পুরো সীমান্তজুড়ে শত শত চোরাচালান রুট দিয়ে মানুষ পাচার হতে পারে। তখনও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বা কর্তারা ব্যস্ত লুটপাটের নানা ফাঁকফোকর খুঁজতে, আড়াই শ’ টাকার সূঁচ পঁচিশ হাজার টাকায় কিনতে বা এক ব্যক্তির ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টীকা আমদানীর মনোপলি লাইসেন্স ইস্যু করতে! এসব বলে আর লাভ নাই। এখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলছে নানা ছেলেমানুষি হঠকারি বা অপরিনামদর্শী কিছু লোক দেখানো মকশো। লক ডাউন মামলা জরিমানা এই হুকুম ওই আদেশ!
সরকারকে কিছু একটা তৎপরতা দেখাতে হবে, দেখিয়ে যাক। কিন্তু করোনার সংক্রমন বা মৃত্যুর সংখ্যা বা হারের তাতে কোন রকমফের হওয়ার কথা নয়। এসব কর্মকান্ড হচ্ছে বাস্তবতা বিবর্জিত। আগের ঢিলা লকডাউন, সাধারন ছুটি, বিধিনিষেধ বা হালের কঠোর লকডাউন- কোনটাতেই কাজ হয় নাই। উল্টো দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার অর্থ দাঁড়ায় প্রকৃত সমস্যার সাথে এসব বিধিনিষেধ লকডাউনের কোন সম্পর্ক নাই। এর মধ্যে মরার ওপর খাড়া ঘা হয়ে আসছে সামনের কোরবানীর হাট, ঈদে মানুষের বাড়ী যাওয়া। ভাব দেখে মনে হচ্ছে সরকার এবার ঈদেও মানুষের গ্রামে ফেরা রুখতে বাস ট্রেন লঞ্চ তথা গন পরিবহন বন্ধ রাখবে, ফলে গতবারের মত এবারও গাদাগাদি করে ট্রাভেল করতে হবে। এতে করে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে বিশেষজ্ঞরা এখনও তার কোন পুর্বাভাষ দিতে পারছেন না।
এখন কথা একটাই- যার যার বাঁচা-মরা নিজের হাতে। মাষ্ক, ব্যক্তি দুরত্ব আর টীকা- এই তিনটাই হচ্ছে রক্ষাকবচ। মাষ্ক পরিধান করতে হবে, বাইরে তো বটেই পারলে ঘরেও ব্যক্তি দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। টীকা অবশ্য এখনও আল্লাহ ভরষা। কিছু কিছু আসছে আসবে, কার কপালে জুটবে বা জুটলেও কবে দ্বিতীয় ডোজ মিলবে, কবে এন্টিবডি তৈরী হবে আর তা করোনার সাথে ফাইটিংয়ে যাবে- এসব নানা লম্বা কাহিনীর ব্যপার!
আপাতত: ওই মাষ্ক আর ব্যক্তি দুরত্ব দিয়েই যতটা নিজেকে বাঁচানো যায়! এর বাইরে যদি কোন সুবিধা জোটে মনে করতে হবে সাত জনমের ভাগ্যি!
2
Like

 

Comment
Share

how do you feel about this website ?

%d bloggers like this: