ডালিম কুমার দাস টিটু ঃ স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনে জোশ ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী নারী উদ্যোক্তা শর্মিলী চৌধুরী অধরা। একটা সময় এই বাংলাদেশটি ছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ । ৭১ পরবর্তী ক্ষতবিক্ষত এই দেশটিকে নিয়ে কতইনা স্বপ্ন দেখেছিলেন সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ঘাতক চক্র তার সেই স্বপ্নকে পূরণ করতে দিলোনা । ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট নির্মম ভাবে স্বপিরবারে হত্যা করা হয় এই স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে। কিন্তু বাবার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়েছেন তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশকে আরো বেশি স্বনির্ভর করতে সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা লক্ষ্যনীয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উদ্যেক্তা হিসেবে ভালো ভূমিকা রাখছেন । একজন উদ্যেক্তা অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উদ্যেক্তা হয়ে ওঠে। এর পরেও শেষ নয় আছে উদ্যেক্তা জীবনের সফলতা ব্যর্থতার পালা। যাইহোক যার কথা বলছি , তিনি হলেন একজন উদিয়মান নারী উদ্যেক্তা শর্মিলী চৌধুরী অধরা।
শর্মিলী চৌধুরী অধরা ১৯৮৪ সালে নোয়াখালী জেলা মাইজদী শহরে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । বাবা ফটিক রায় চৌধুরী মা সান্তনা চক্রবর্তী । দুইবোন এক ভাইয়ের মধ্যে শর্মিলী চৌধুরী মেঝো। মাইজদী শহরেই বেড়ে ওঠা শর্মিলী চৌধুরীর । পড়ালেখায় নোয়াখালী সরকারী কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন । পাশাপাশি এমবিএ (ফিন্যান্স) করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি থেকে। শিক্ষাজীবন শেষ করেই লক্ষ্মীপুর জেলার , টুমচর গ্রামের স্বর্গীয় কমল চন্দ্র দাসের ছোট ছেলে কনক চন্দ্র দাসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । শুরু হয় শর্মিলীর নতুন জীবন। জীবন সঙ্গী হিসেবে কনক চন্দ্র দাসকে পেয়ে নিজের বৈবাহিক বন্ধন স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করেন শর্মিলী। শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টাও করেছেন তিনি । পরিবারের সদস্যরাও তাকে চাকরির জন্য এবং নিজে সাবলম্বী হওয়ার জন্য উৎসাহ দিতেন । কারন নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই যেখানে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী , শিক্ষামন্ত্রী নারী , রাজপথে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় নারীরা সেখানে মাস্টার্স পাস করে শর্মিলী চৌধুরী একটি চাকরির চেষ্টা করাটাই স্বাভাবিক । বলা যায় নারীর অধিকার এখন সময়ের দাবী । বিয়ের পরেও স্বামী এবং সংসারকে সাপোর্ট করার জন্য চাকরির প্রয়োজন বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি । এরিমধ্যে তাদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান । সন্তান হওয়ার পরপরই চাকরির বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে সংসারের প্রতি নজর দেন তিনি । এর মধ্যেই শর্মিলী চৌধুরী একর পর এক অভিবাবক শূণ্য হন । চার বছরের মধ্যে ভগবানের ডাকে শশুর-শাশুড়ী এবং বাবাকে চলে যেতে স্বর্গে। যেন শর্মিলীর জীবনে একটি ঝড় বয়ে গেলো । একরকম ভেঙ্গে পড়েন তিনি । কিন্তু নিয়তিকেতো মেনে নিতেই হবে । নিজেকে শক্ত করে সংসার সংগ্রামে চলতে থাকে তার জীবন । চার বছর পর দ্বিতীয় সন্তান একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন শর্মিলী। বছর দেড়েক যেতে না যেতেই আবারো শুরু হলো নতুন সমস্যা । স্বামীর অফিস বন্ধ করে দিতে হলো । আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়তে শুরু হলো তাকে। তিনি মনে মনে চিন্তা করেন কিভাবে এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠবেন । প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে তিনি নিজেই যান । উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা শর্মিলী যেভাবে জানিয়েছেন । শুনবো তার নিজের কাছে। তিনি বলেন , আমি মেয়েকে স্কুলে দিতে গিয়ে মা-মেয়ে দুজনেই দেখতাম মেয়ের ফ্রেন্ডদের মা স্কুলে বিভিন্ন ধরনের পণ্য এনে বিক্রি করতো। প্রথম প্রথম বুঝতামনা পরে বুঝলাম ওরা স্বামীর ওপর নির্ভর না থেকে নিজেকে সাবলম্বী করতে এই কাজ করছে। এমন উদ্যোগ নেয়ার পেছনে আমার মেয়েই প্রথম আমাকে উৎসাহ দেয় । হঠাৎ একদিন মেয়ে বলল মা তুমি অনলাইনে ব্যবসা শুরু করো। মেয়ের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে সেদিনই ঝোঁকের মাথায় একটি পেইজ খুলি। কিছু শার্ট এনে ছবি তুলে পোস্ট করি। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না কিভাবে পেইজ সাজাবো,কিভাবে পেইজে কন্টেন্ট লিখবো। হতাসার মধ্যে পড়ে গেলাম। ৭ দিনের মধ্যে আমার কিছু শার্ট সেল হলো । আমি পেলাম ২০০০ টাকা। সেদিন আমি এত বেশি খুশি হলাম কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। মনের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করতে থাকলো । নিজের মধ্যে একধরনের শক্তি সৃষ্টি হলো। মনে হোলো উদ্যোক্তা হিসেবে আমি সফলতা লাভ করবো । শুরু হলো আমার নতুন সংগ্রাম । বিষয়টি ধীরে ধীরে বন্ধু মহলে জানালাম ,আত্মীয়স্বজন,পরিবারের অনেকের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করি। সবাই দেখি আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে । সবাইর উৎসাহ পেয়ে আমিও শুরু করি অনলাইন ব্যবসা । বর্তমানে আমি উদ্যেক্তা হিসেবে এক বছর চার মাস পার করছি ।
ঠিক এমন সময় আমার উদ্যেক্তার ভিত মজবুত করা এবং আমাকে সহযোগতিার হাত বাড়িয়ে দিতে দেবদূত হয়ে আসেন এম ডি সৌভিকুর রহমান। আমার সাথে তার দেখা হয় ডিএসবির মাধ্যমে । তিনি এক স্বপ্নবাজ মানুষ। উদ্যোক্তা হিসেবে আমার লালিত স্বপ্নটাকে বাস্তবে দাঁড় করাতে উনার সহযোগিতা ছিলো অনন্য। তাই আমার উদ্যেক্তা হওয়ার পেছনে উনি আমার মেন্টর। তিনি হলেন যশোর পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের আইটির প্রফেসর। উনার আইসিটি কেয়ার নামে নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান আছে। উনার প্রতিষ্ঠান আইসিটি কেয়ারের মাধ্যমে আমার পেইজের সেটিংস সহ আইটি রিলেটেড পুরো ডেকোরেশন করা হয়। এরপর আমি একটি গ্রুপের সাথে জড়িত। বর্তমানে আমি Dreaming platform Bangladesh (DPB) নামে একটি গ্রুপ কাজ করি।এই গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য । গ্রুপের এডমিন সৌভিকুর রহমান ভাই। গ্রুপটি একটি শিক্ষণীয় গ্রুপ , প্রতিনিয়ত এই গ্রুপ থেকে অনেক কিছু শিখছি এবং আমার উদ্যোক্তা জীবনে কাজে লাগাচ্ছি।এই গ্রুপের আঞ্চলিক প্রতিধিনি হিসেবে কিছুদিন আগে আমাকে নির্বাচিত করেছেন । তার জন্য আমার মেন্টর সৌভিকুর রহমান ভাই এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার জোশ ব্র্যান্ডের নামকরণের পিছনে সম্পূর্ণ অবদান আমার মেন্টরের।আমার মেন্টর সবসময় আমাকে উৎসাহ,অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। বর্তমানে আমার এই কাজে আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন আমার হাজবেন্ড,মা,ভাই সহ পরিবারের সদস্যরা। তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, উদ্যোগ নেয়ার পর অনেকেই ছিলেন যারা আমাকে নেতিবাচক চিন্তা করতেন। এছাড়াও অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। আমার Zosh ব্র্যান্ড এখন দেশের প্রায় জেলাগুলোতে যাচ্ছে এবং দেশের বাইরেও যাচ্ছে। তবো বিভিন্ন সময় পণ্যের বাজার চাহিদা মেটাতে পারছি না। ধীরে ধীরে আমার সৃষ্টিকে নিয়ে আমি এগোচ্ছি।
শর্মিলী চৌধুরী বর্তমানে Zosh ব্র্যান্ড এর জেন্টস আইটেম নিয়ে কাজ করছেন । আগামীতে একজন সফল উদ্যেক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তিনি সকলের আশীর্বাদ কামনা করছেন । শিক্ষিত তরুন সমাজ এবং নারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে এই নারী উদ্যেক্তা শর্মিলী চৌধুরী অধরা বলেন, : তরুনরাই পারে সব প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। শুধু চাকরির পেছনে পড়ে থাকলে চলবেনা । আমি চাকরি দেব এই চিন্তাকে মাথায় এনে কাজ করতে হবে তাহলেই একজন উদ্যেক্তা তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি সব তরুনের মধ্যেই স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন পূরণের পরিকল্পনাও আছে, নেই শুধু পাশে থেকে সাহস যোগানোর যোগ্য মানুষ। আমি চাই, তাদের সেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়নের সাহস যোগাতে। চাই বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে , অর্থনীতির মূলস্রোতের সাথে তরুন এবং যুবকরা যুক্ত হোক । অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করতে তরুনরাই গড়বে, সোনার বাংলাদেশ। আমার স্বামী আছেন , আমি কেন শুধু আমার স্বামীর ওপর নির্ভর করবো । নারীরা কিন্তু এখন কোন দিকে পিছিয়ে নেই। চাইলে আমিও পারি একজন উদ্যেক্তা হয়ে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করতে। নারী উদ্যেক্তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় পরিবারের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুক্ষীন হতে হয় পাশাপাশি আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টিও হয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন এবং সেই সাথে একজন উদ্যেক্তা নিজের রাস্তা নিজে তৈরি করার চেষ্টা করেন যার কারনে ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি তাই তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন শর্মিলী চৌধুরী অধরা। উদ্যোক্তা হয়ে দেশের হাজার হাজার নারী আজ সাবলম্বী । তেমনি অধরারও স্বপ্ন একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার । বর্তমানে অনেক তরুন ও যুব সমাজ নিজেরাই অল্প পুঁজি নিয়ে উদ্যেক্তা হয়ে দেশ ,সমাজ এবং জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন ।